Hey, like this? Why not share it with a buddy?
প্রায় একবছর আগে ক্যাম্পাসে নৃশংস এক হত্যাকান্ডের সাক্ষী হই আমরা। কি হয়েছিলো সেই রাতে, কি হয়েছিলো এরপর? এক বছরের চাকা ঘুরতেই আমাদের মধ্য থেকে আবরার ফাহাদের আত্মত্যাগের স্মৃতিগুলো মিইয়ে যেতে শুরু করেছে।
তাই আমরা চাই ৬ অক্টোবর থেকে আগের পরের ঘটনাগুলো উঠে আসুক আমাদের লেখায়৷ যাতে পুনর্জীবিত হয় আমাদের নেওয়া শপথ, আর সবার সামনে একটা সঠিক ফার্স্ট হ্যান্ড চিত্র তুলে ধরা যায়৷ আমরা ফাহাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে সকল ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা নিয়ে তৈরী করছি আর্কাইভ, যাতে বছরের পর বছর মানুষের মনে গেঁথে থাকে সেই রাতের নৃশংসতা আর বুয়েটের কালো অধ্যায়।
৬ অক্টোবর, ২০১৯
আবরার ফাহাদ রাব্বী, রোলঃ ১৭০৬০৯৮। বাড়ি কুষ্টিয়া। তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী(এইচএসসি ২০১৭, সংক্ষেপে ১৭ ব্যাচ)। ২০ তারিখ থেকে আমাদের টার্ম ফাইনাল শুরু হওয়ার কথা ছিলো। ১৭ ব্যাচের জন্য সেটা ছিলো ২-১ এর টার্ম ফাইনাল। পিএলের জন্যে হল অনেকটাই ফাঁকা ছিলো। ফাহাদও বাড়িতেই ছিলো। পরীক্ষার দুই সপ্তাহ আগেই, ৬ অক্টোবর বিকাল ৫ টায় ফাহাদ শেরে বাংলা হলে ফিরে, পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্যেই ঢাকায় ফেরা। ফেরার পরে তার মা বাবার সাথে কথা হয়েছিলো। ওর রুম নাম্বার ১০১১। রাতে পড়বে বলে ঘুমিয়ে যায় ফাহাদ, ৯ টার দিকে ডেকে দিতে বলেছিল রুমমেটকে।
অন্যদিকে আবরারকে দেখে নেওয়ার প্ল্যান অনেক আগে থেকেই রেডি করা ছিলো। তখন বুয়েট ছাত্রলীগের গ্রুপে এগুলো নিয়ে নিয়মিতই প্ল্যানিং হতো, তার অনেক নমুনা ছিলো। রাজনৈতিক ক্ষমতার দৌরাত্ম্য দেখানোর এক মোক্ষম অস্ত্র ছিলো টার্গেট করে নিরপরাধ ছাত্রদের উপর অকথ্য নির্যাতন। আর ফাহাদ ছিলো ওইরকমই একজন যার উপর তাদের নজর পড়ে গিয়েছিলো। অমিত সাহার (তৎকালীন উপ-আইন সম্পাদক, বুয়েট ছাত্রলীগ) একটা ম্যাসেজেও দেখা যায় সে খোঁজ নিচ্ছে আবরার ফেরত আসছে কিনা হলে। বাড়ি থেকে আসলেই তাকে নিয়ে আসার দায়িত্ব পড়ে কয়েকজনের উপর।
রাত ৮ঃ১৩ তে তাকে ঘুম থেকে তুলে ডেকে নিয়ে যায় ১৭ ব্যাচের সাদাত, তানিম। ফাহাদকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় তার রুমের ঠিক উপরের রুমেই, ২০১১ তে। সেখানে ছিলো বুয়েট ছাত্রলীগ শাখার পদস্থ নেতারা, মেহেদী হাসান রাসেল, মেহেদী হাসান রবিন, মেফতাহুল হক জিয়ন, ইফতি মোশাররফ সকাল, অনিক সরকার, অমিত সাহাসহ আরো অনেকে। একটানা নির্যাতনে ভেঙে যায় কয়েকটা মোটা কাঠের স্ট্যাম্প, কালশিটে পরে যায় সারা শরীরে, আবরার আর্তনাদ করে একটু পানির জন্যে। "ওগুলো ওর ঢং" বলে ক্ষান্ত দেয় নি সেদিন খুনের নেশায় উন্মত্ত রবিন, অনিক। মারপিটের পর তার অবস্থা বেশি খারাপ হলে ১৭ এর বিভিন্ন ছেলেকে ডেকে আনা হয়েছিলো। ১ঃ১২ তে আবরারকে ২০০৫ নাম্বার রুমে নিয়ে যাওয়া হয়।
ঘটনা শেষ হয় না এখানেই।
আরো সলাপরামর্শের পরে রাত ২ টার দিকে হলে পুলিশকে ডাকে ছাত্রলীগের নেতারা, "হলে শিবির ধরা পরেছে" বলে ধরিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হওয়ার জন্য। একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে পুলিশ ডাকার জন্যে তাদের প্রয়োজন ছিলো না প্রভোস্টের কোনো অনুমতি বা ডিএসডব্লিউ এর অনুমতি, সবাই ছিলো তাদের হাতের পুতুল। ফাহাদের অবস্থা অতিরিক্ত খারাপ ধারণা করে তারা পুলিশ ডাকলেও সেই পুলিশকেও ঢুকতে দেয় নি। পুলিশ অপেক্ষা করে চলে যায়। সে মৃতপ্রায় ধারণা করে রাত ২ঃ৩৪ এ তাকে ২০০৫ থেকে নিয়ে সিঁড়িতে ফেলে দেওয়া হয়েছিলো৷ এরপর নাস্তা কিনতে নামার পথে অন্য ছেলে তাকে দেখে, জানা জানি হয়। এরপর ৩ঃ০৪ এ বুয়েটের ডাক্তার আসেন, তিনি আবরারকে দেখে জানান যে সে আরো আগেই মারা গিয়েছিলো। ৩ঃ১৫ তে ফাহাদকে নিচে নামায় আনা হয়৷ ৩ঃ২৫ এ প্রভোস্ট এবং ডিএসডব্লিউ আসেন।
সময়গুলো, নামগুলো জানা খুব ইম্পর্ট্যান্ট ছিলো তখন। কারণ ঘটনা এমনভাবে সাজানোর চেষ্টা করা হচ্ছিলো যেন হঠাৎ করে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেলো। অথচ প্রকৃতপক্ষে প্রায় অর্ধমৃত অবস্থায় রাত একটা থেকে তিনটা পর্যন্ত, প্রায় দুইঘন্টা ফাহাদকে হলের অন্য একটা রুমেই ফেলে রাখা হয়েছিলো, পাশের ঢাকা মেডিকেল দূরে থাক, বুয়েট ডাক্তারকেও ডাকা হয় রাত তিনটায়। ডিএসডব্লিউ স্যার আর বুয়েটের ডাক্তার রাত ৩ঃ২৫ এ সেখানে উপস্থিত হওয়ার পরেও পাশে থেকে রাসেলসহ অন্য নেতারা এমনি আঘাত বা এমন কিছু বলে সেটা ধামাচাপা দিতে চেয়েছে। পরে সেখানের ডাক্তার ফাহাদের হাত পা দেখায় বলেন(যেটা আমরা পরে সিসিটিভি ফুটেজে দেখতে পাচ্ছিলাম) "এগুলা এমনি মার তুমি আমাকে শিখাতে চাও?" সেখানে উপস্থিত মেহেদী হাসান রাসেলই মূলত কথা বলছিলো। ডিএসডব্লিউ ১৭ ব্যাচের উপস্থিতদের সাথে আলাদা করে কথা বলার জন্য ১০১১ তে গেলে রাসেল সেখানেও দরজা ভেঙ্গে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করে। এরপর চারটার দিকে আবার পুলিশ ডাকেন স্যাররা এবং আবরারের লাশ সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেলের মর্গে। আমরা পরে জানতে পেরেছিলাম ফাহাদের রুমে অন্য কিছু রেখে তাকে ফাঁসানোর চেষ্টাও করা হয়েছিলো।
উপস্থিত ১৭ ব্যাচের সবাই অনেক সাহস সঞ্চয় করে একই রকম স্ট্যাটাস লিখে এবং সকল গ্রুপে একযোগে পোস্ট দেয়। সেই পোস্টের জন্যেই বাইরে পৌছানো সম্ভব হয় ঘটনাটা। এমনকি ওইদিন ভোর ৬ টায় কে প্রথম পোস্ট দিয়েছে তাকেও খুঁজাখুঁজি হয়। এতটাই ছিলো খুনিদের দাপট। পরিস্থিতি ছিলো এতটাই ভীতিকর। জানাজানি শুরু হলে ১৭ এর সবাই শেরেবাংলা হলে একত্রিত হয়। কারো জন্যে ৭ তারিখ দিন শুরুই হয়েছিলো গভীর রাতে, কারো জন্যে ভোরবেলা ডাকাডাকি শুনে।
তখনও এতটা পরিষ্কার ছিলো না কি ঘটেছে কারা ঘটিয়েছে। মুখ খুলছিলো না কেউই। খুনিরা নির্লিপ্তভাবে বসে ছিলো হলের রুমে। এগুলো জানার জন্যে আমাদের প্রয়োজন ছিলো হলের সিঁড়িতে থাকা সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্যে এই ফুটেজের এক কপির দাবিতে ৭ অক্টোবর মাটি আঁকড়ে থেকে রীতিমতো যুদ্ধ করে বুয়েটের শিক্ষার্থীরা।